বাংলাদেশে ঈদুল আজহার আগে বাজারে আসছে নতুন ২০ টাকার নোট, যা ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ফেসবুক, এক্স, এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে নানা ধরনের ডিজাইন ভাইরাল হওয়ায় জনমনে কৌতূহল ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন, এটি নতুন সরকারের সংস্কারের প্রতিফলন, আবার কেউ এগুলোকে ‘ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে বাস্তবতা কী? এই নিবন্ধে আমরা ২০ টাকার নতুন নোটের ডিজাইন, বিতর্ক, এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসিয়াল অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
২০ টাকার নতুন নোট: ডিজাইন ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে, ঈদুল আজহার আগেই বাজারে আসছে নতুন ডিজাইনের ২০, ৫০, এবং ১০০০ টাকার নোট। এই নোটগুলোতে দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, এবং সাংস্কৃতিক প্রতীক প্রাধান্য পাবে। বিশেষ করে ২০ টাকার নোটে কান্তজিউ মন্দিরের ছবি থাকতে পারে বলে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা চলছে, যেখানে পূর্বে ষাট গম্বুজ মসজিদের ছবি ছিল। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এই ডিজাইন চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “নতুন নোটে কোনো ব্যক্তির ছবি থাকবে না। আমরা চাই আমাদের ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরতে।” তিনি আরও জানান, মসজিদ, মন্দির, বা অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা—সবই এই নোটের ডিজাইনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটাবে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ নতুন নোট ছাপানো হচ্ছে। এই নোটগুলো গাজীপুরের দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (টাঁকশাল) থেকে ছাপা হচ্ছে। ২০ টাকার নোটের ছাপা প্রায় শেষ পর্যায়ে, এবং এটি আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ডিজাইন ও বিতর্ক
সামাজিক মাধ্যমে ২০ টাকার নতুন নোটের কথিত ডিজাইনের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু ছবিতে কান্তজিউ মন্দিরের চিত্র দেখা গেলেও, অনেক ছবিতে তারেক রহমান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মাহফুজ আলম, এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতির ছবি দেখা গেছে। এই ডিজাইনগুলো নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ এগুলোকে নতুন সরকারের নিরপেক্ষ নীতির প্রতীক হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ বলছেন এগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন স্পষ্ট করেছেন, “সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলো নিয়ে আমরা সরাসরি মন্তব্য করছি না। এগুলো আসল হতে পারে, আবার ফেইকও হতে পারে। নোটের ডিজাইন বাজারে আসার আগে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।” তিনি আরও জানান, নতুন নোট বাজারে এলে সাধারণ মানুষ নিজেরাই এর সত্যতা যাচাই করতে পারবেন।
এই বিতর্কের পেছনে আরেকটি কারণ হলো পূর্ববর্তী নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকা। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে অনেকে শেখ মুজিবের ছবি নতুন নোট থেকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। ফলে গত মার্চে এই ছবিযুক্ত নোটের বিনিময় স্থগিত করা হয়, যা বাজারে ছেঁড়া-ফাটা নোটের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
নোট ডিজাইনের পেছনের নীতিমালা ও তাৎপর্য
নতুন নোটের ডিজাইনের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য হলো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরা। ২০ টাকার নোটে কান্তজিউ মন্দিরের ছবি যদি সত্যিই থাকে, তবে তা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি প্রতিফলন হবে। কান্তজিউ মন্দির, দিনাজপুরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, এর স্থাপত্যশৈলী ও শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত।
পূর্ববর্তী নোটগুলোতেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
১০ টাকার নোট: বালুভূমি ও বাঁশের ঘর।
৫ টাকার নোট: গ্রামীণ দৃশ্য।
১০০০ টাকার নোট: জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও জাতীয় সংসদ ভবন।
এই ধরনের ডিজাইন সাধারণত রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সতর্কতার সাথে নির্বাচন করা হয়। নতুন নোটে ব্যক্তির ছবি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তও এই নীতির অংশ, যাতে কোনো রাজনৈতিক বিভাজন বা বিতর্ক না হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান ও প্রস্তুতি
বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছাড়ার প্রস্তুতি পুরোদমে চালাচ্ছে। টাঁকশালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০ টাকার নোটের ছাপা প্রায় শেষ, এবং এটি শীঘ্রই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ৫০ ও ১০০০ টাকার নোটও পর্যায়ক্রমে ছাপা হবে। প্রথমে এই নোটগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় ও অন্যান্য শাখায় সরবরাহ করা হবে, এবং পরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হবে।
তবে, টাঁকশালের সীমিত সক্ষমতার কারণে একসঙ্গে তিনটির বেশি মূল্যমানের নোট ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রথম ধাপে ২০, ৫০, এবং ১০০০ টাকার নোট ছাড়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ঈদের আগে সীমিত পরিসরে এই নোটগুলো বাজারে আসবে, তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হতে পারে।
জনগণের করণীয়: বিভ্রান্তি এড়ানো
নতুন নোট নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো স্বাভাবিক। তবে, জনগণের দায়িত্বশীল আচরণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো ছবি বা তথ্য যাচাই না করে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে ঈদের আগেই নতুন নোট বাজারে আসবে, এবং তখনই এর প্রকৃত ডিজাইন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এছাড়া, পুরোনো ২০ টাকার নোট বৈধ থাকবে, তাই নতুন নোট চালু হলেও পুরোনো নোট বাতিল হবে না। জনগণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসিয়াল ঘোষণার ওপর ভরসা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
FAQs: ২০ টাকার নতুন নোট সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন
২০ টাকার নতুন নোট কবে বাজারে আসবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল আজহার আগে, সম্ভবত জুনের ২ বা ৩ তারিখের মধ্যে নতুন ২০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হবে।
নতুন নোটে কী ধরনের ছবি থাকবে?
অনুমান করা হচ্ছে, ২০ টাকার নোটে কান্তজিউ মন্দির ও বৌদ্ধমন্দিরের ছবি থাকতে পারে। তবে, চূড়ান্ত ডিজাইন এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
ভাইরাল হওয়া ডিজাইনগুলো কি আসল?
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ছবিগুলো আসল বা নকল হতে পারে। নোট বাজারে এলে সত্যতা যাচাই করা যাবে।
পুরোনো ২০ টাকার নোট কি চলবে?
হ্যাঁ, পুরোনো ২০ টাকার নোট বৈধ থাকবে। নতুন নোট চালু হলেও পুরোনো নোট বাতিল হবে না।
নতুন নোটের ডিজাইন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী বলছে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে এবং ঈদের আগে সঠিক তথ্য প্রকাশ করবে। নোটে কোনো ব্যক্তির ছবি থাকবে না, বরং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীক থাকবে।
ভবিষ্যতে অন্য মূল্যমানের নোটেও কি পরিবর্তন আসবে?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ ও ১০০০ টাকার নোটের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে অন্য মূল্যমানের নোটেও নতুন ডিজাইন আনার পরিকল্পনা করছে।
২০ টাকার নতুন নোট নিয়ে বাংলাদেশে উৎসাহ ও বিতর্ক দুটোই চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, এই নোটগুলো দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটাবে। তবে, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ডিজাইনগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি এড়াতে সতর্ক থাকা জরুরি। ঈদের আগে নতুন নোট বাজারে এলে প্রকৃত ডিজাইন সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হতে পারবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসিয়াল তথ্যের ওপর নির্ভর করাই শ্রেয়।