‘AI চাকরি খেয়ে নেবে’—এই ভয় থেকে শুরু করে ‘AI গোপন ছবি ফাঁস করে দেবে’—ব্যবহারকারীদের মধ্যে আশঙ্কার ধরন বদলাচ্ছে। কিন্তু শুধু ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ভয়ই কি একমাত্র সমস্যা? মোটেও নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এর প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামগ্রিক পরিবেশ ও জলবায়ুর উপরেও পড়ছে। রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ বিষয়ক বিভাগ (UNEP)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, AI-এর হার্ডওয়্যার তৈরি ও ডেটা সেন্টার পরিচালনা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো কীভাবে AI পরিবেশের ক্ষতি করছে এবং কীভাবে এর সমাধান করা যায়।
১. ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ এবং কার্বন নির্গমন
AI মডেল, বিশেষ করে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (LLM) পরিচালনার জন্য ডেটা সেন্টারগুলোর প্রয়োজন বিশাল কম্পিউটিং পাওয়ার। এই পাওয়ার তৈরির জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল, যার ফলে কার্বন নির্গমন ক্রমাগত বাড়ছে।
উদাহরণ: মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠান ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে কার্বন নির্গমন ৩০% বাড়িয়েছে।
আশঙ্কা: রাষ্ট্রসংঘের মতে, আগামী ১-২ বছরে AI-এর জন্য কার্বন নির্গমন দ্বিগুণ হতে পারে।
এই বিদ্যুৎ খরচ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। সৌর, বায়ু এবং হাইড্রোপাওয়ারের মতো শক্তি উৎসের দিকে মনোযোগ দিলে পরিবেশের উপর চাপ কমতে পারে।
২. ডেটা সেন্টারে জলের অপচয়
AI ডেটা সেন্টারগুলোকে ঠান্ডা রাখতে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি পানি ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রের নোনা জল এ কাজে ব্যবহার করা যায় না, তাই পানীয় জলের সমতুল্য মিষ্টি পানির উপর নির্ভর করতে হয়।
তথ্য: ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ১০০ মেগাওয়াটের ডেটা সেন্টার প্রতিদিন ২০ লক্ষ লিটার জল খরচ করে, যা ৬৫০০ পরিবারের জলের চাহিদার সমান।
প্রজেকশন: ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ডেটা সেন্টারগুলো বছরে ১২০০ বিলিয়ন লিটার জল খরচ করতে পারে, যা বর্তমানের ৫৬০ বিলিয়ন লিটারের দ্বিগুণেরও বেশি।
এশিয়ার কয়েকটি দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামছে, এবং গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুলতে হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে পানীয় জলের সংকট তৈরি করতে পারে।
সমাধান: জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য কুলিং সিস্টেম এবং শুকনো কুলিং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।
৩. ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যের ক্রমবর্ধমান সমস্যা
AI মডেল তৈরিতে ব্যবহৃত হার্ডওয়্যার, যেমন চিপ এবং GPU, দ্রুত পুরনো হয়ে যায় এবং ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যে পরিণত হয়।
প্রভাব: এই বর্জ্য থেকে লেড, পারদের মতো ক্ষতিকর পদার্থ মাটি ও পানিতে মিশে পরিবেশ দূষণ ঘটায়।
আশঙ্কা: ই-বর্জ্য ফেলার স্থানের আশপাশে মাটি ও পানি কৃষি বা পানীয়ের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে।
সমাধান: ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং দায়িত্বশীল নিষ্পত্তির জন্য কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
৪. অনিয়ন্ত্রিত খনিজ মাইনিং
AI চিপ তৈরির জন্য টাইটেনিয়াম, লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম, গ্রাফাইটের মতো দুষ্প্রাপ্য খনিজ প্রয়োজন। এই খনিজ উত্তোলনের জন্য প্রায়ই পরিবেশবান্ধব নিয়ম মানা হয় না।
উদাহরণ: ইউক্রেনে এই ধরনের খনিজ উত্তোলনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
প্রভাব: অনিয়ন্ত্রিত মাইনিং মাটি ও পানির দূষণ ঘটায় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে।
সমাধান: টেকসই মাইনিং পদ্ধতি এবং খনিজ পুনর্ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া দরকার।
উপসংহার: পরিবেশ ও AI-এর ভারসাম্য
AI যেন আধুনিক যুগের এক ‘হীরক রাজার গবেষক’—সামনে থেকে চোখ ধাঁধানো কাণ্ড দেখাচ্ছে, আর পিছন থেকে নিঃশব্দে খরচ করছে বিদ্যুৎ, জল এবং পরিবেশের ভারসাম্য। এই প্রযুক্তির সুবিধা নিতে গিয়ে যদি পরিবেশের ‘মগজ ধোলাই’ হয়ে যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধুই নস্টালজিয়ায় বলবে, “একটা সময় ছিল, যখন গাছ দেখা যেত!”
পরিবেশ সুরক্ষার জন্য AI কোম্পানিগুলোকে নবায়নযোগ্য শক্তি, জল পুনর্ব্যবহার এবং টেকসই হার্ডওয়্যার ব্যবহারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমাদের সকলের দায়িত্ব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা।