আমাদের বাড়ির আলমারিতে বা পূজার ঘরে প্রায়ই সাদা, তীব্র গন্ধযুক্ত ছোট ছোট বল দেখা যায়। অনেকে কর্পূর (Camphor) এবং ন্যাপথলিন (Naphthalene)-কে একই জিনিস মনে করেন কারণ এদের চেহারা ও গন্ধে মিল রয়েছে। কিন্তু এই দুটি পদার্থের রাসায়নিক গঠন, উৎস, ব্যবহার এবং মানবদেহে প্রভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। কর্পূর প্রাকৃতিক ও ঔষধি গুণসম্পন্ন, যেখানে ন্যাপথলিন শিল্পজাত এবং সম্ভাব্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ। এই নিবন্ধে আমরা কর্পূর ও ন্যাপথলিনের পার্থক্য, ব্যবহার এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
কর্পূর কী?
কর্পূর হলো একটি সাদা, মোমের মতো দানাদার পদার্থ, যা তার শীতল ও সতেজ সুগন্ধের জন্য পরিচিত। এটি একটি জৈব যৌগ এবং এর রাসায়নিক গঠন ন্যাপথলিনের থেকে আলাদা।
উৎস ও রাসায়নিক গঠন
রাসায়নিক সূত্র: C₁₀H₁₆O
শ্রেণী: টারপিনয়েড (Terpenoid) শ্রেণীর যৌগ, যার মধ্যে একটি কিটোন কার্যকরী গ্রুপ রয়েছে।
প্রাকৃতিক উৎস: কর্পূর গাছ (Cinnamomum camphora)-এর কাঠ, ডালপালা ও পাতা থেকে পাতন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত। প্রাকৃতিক কর্পূর স্বচ্ছ এবং শীতল সুগন্ধযুক্ত।
সিন্থেটিক উৎস: টারপেনটাইন তেল থেকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি সিন্থেটিক কর্পূর। প্রাকৃতিক কর্পূর অপটিক্যালি সক্রিয়, সিন্থেটিক কর্পূর তা নয়।
কর্পূরের ব্যবহার ও উপকারিতা
কর্পূর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে:
ঔষধি ব্যবহার: কর্পূরের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি ব্যথা, চুলকানি, ত্বকের জ্বালাপোড়া কমায় এবং সর্দি-কাশি বা বুকে কফ জমলে বাষ্প গ্রহণে স্বস্তি দেয়। ভিক্স ভেপোরাবের মতো পেইন-রিলিফ বামে কর্পূর ব্যবহৃত হয়।
পোকামাকড় তাড়ানো: মশা, মাছি, পিঁপড়া ও ছারপোকা তাড়াতে কর্পূর প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কার্যকর। এটি ন্যাপথলিনের তুলনায় নিরাপদ।
অ্যারোমাথেরাপি ও ধর্মীয় কাজ: মানসিক চাপ কমাতে এবং পরিবেশ শুদ্ধ করতে পূজার আরতিতে কর্পূর জ্বালানো হয়। এর সুগন্ধ শান্তিদায়ক।
ন্যাপথলিন কী?
ন্যাপথলিনও একটি সাদা দানাদার পদার্থ, তবে এর গন্ধ উগ্র ও তীব্র, যা সাধারণত “মথবলের গন্ধ” হিসেবে পরিচিত। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রাসায়নিক যৌগ।
উৎস ও রাসায়নিক গঠন
রাসায়নিক সূত্র: C₁₀H₈
শ্রেণী: পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (PAH), দুটি বেনজিন রিং দ্বারা গঠিত।
উৎস: কয়লার আলকাতরা বা অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম তেল থেকে উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত। এটি সম্পূর্ণ শিল্পজাত পদার্থ।
ন্যাপথলিনের ব্যবহার
মথবল হিসেবে: কাপড় বা বইয়ে মথের আক্রমণ থেকে রক্ষায় ব্যবহৃত। এর বাষ্প মথের লার্ভা ও প্রাপ্তবয়স্ক মথের জন্য বিষাক্ত।
শিল্পক্ষেত্রে: থ্যালিক অ্যানহাইড্রাইড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত, যা প্লাস্টিক, রঙ, কীটনাশক ও ডাই উৎপাদনে প্রয়োজন।
অন্যান্য: একসময় মাটির ফিউমিগ্যান্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তবে বিষাক্ততার কারণে এখন ব্যবহার কম।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
ন্যাপথলিন মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং সম্ভাব্য কার্সিনোজেন:
স্বল্পমেয়াদী প্রভাব: মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব: লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে অ্যানিমিয়া, ক্যান্সারের ঝুঁকি।
পরিবেশ দূষণ: গাড়ি ও সিগারেটের ধোঁয়ায় উপস্থিত ন্যাপথলিন মাটি ও পানি দূষিত করে।
কর্পূর বনাম ন্যাপথলিন: মূল পার্থক্য
নিচের সারণিতে কর্পূর ও ন্যাপথলিনের মূল পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | কর্পূর (Camphor) | ন্যাপথলিন (Naphthalene) |
---|---|---|
রাসায়নিক সূত্র | C₁₀H₁₆O | C₁₀H₈ |
শ্রেণী | টারপিনয়েড কিটোন | পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন |
উৎস | কর্পূর গাছ বা টারপেনটাইন তেল | কয়লার আলকাতরা বা পেট্রোলিয়াম |
গন্ধ | শীতল, সতেজ সুগন্ধ | উগ্র, মথবলের গন্ধ |
গলনাঙ্ক | ১৭০° সেলসিয়াসের উপরে | প্রায় ৮০° সেলসিয়াস |
পানিতে দ্রাব্যতা | সামান্য দ্রবণীয়, পানিতে ভাসে | অদ্রবণীয়, পানিতে ডুবে যায় |
ব্যবহার | ঔষধি, পূজা, অ্যারোমাথেরাপি, কীটনাশক | মথবল, শিল্প রাসায়নিক উৎপাদন |
বিষাক্ততা | তুলনামূলকভাবে নিরাপদ | বিষাক্ত, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী |
কোনটি ব্যবহার করা উচিত?
কাপড় বা বই সুরক্ষা: ন্যাপথলিনের পরিবর্তে কর্পূর ব্যবহার করুন। এটি প্রাকৃতিক, নিরাপদ এবং ক্ষতিকর প্রভাব কম।
পূজা বা সুগন্ধ: ধর্মীয় কাজে বা ঘরে সুগন্ধ ছড়াতে কর্পূর ব্যবহার করুন। এর পবিত্র ও শীতল গন্ধ উপযুক্ত।
ঔষধি প্রয়োজন: ব্যথা, সর্দি-কাশি বা ত্বকের সমস্যায় কর্পূর বা কর্পূরযুক্ত পণ্য ব্যবহার করুন। ন্যাপথলিনের কোনো ঔষধি গুণ নেই এবং এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সতর্কতা
ন্যাপথলিনের ব্যবহার সীমিত করুন: এটি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন এবং দীর্ঘ সময় শ্বাস নেওয়া এড়ান।
কর্পূরের অতিরিক্ত ব্যবহার: অতিরিক্ত কর্পূর গ্রহণ বা ত্বকে বেশি ব্যবহার জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ব্যবহার করুন।
কেনার সময় সচেতনতা: কর্পূর কিনতে গিয়ে ন্যাপথলিন কিনে ফেলবেন না। প্যাকেজিং ও উৎপাদকের তথ্য পরীক্ষা করুন।
কর্পূর ও ন্যাপথলিন সম্পর্কিত প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
১. কর্পূর এবং ন্যাপথলিন কি একই জিনিস?
না, কর্পূর ও ন্যাপথলিন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি রাসায়নিক পদার্থ। কর্পূর (C₁₀H₁₆O) প্রাকৃতিকভাবে কর্পূর গাছ থেকে পাওয়া যায় এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। ন্যাপথলিন (C₁₀H₈) শিল্পজাত, মথবল হিসেবে ব্যবহৃত এবং বিষাক্ত।
২. কর্পূরের প্রধান ব্যবহার কী?
কর্পূর ঔষধি ব্যবহার (ব্যথা উপশম, সর্দি-কাশি), পূজার আরতি, অ্যারোমাথেরাপি এবং প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ত্বকের জ্বালাপোড়া ও চুলকানি কমাতেও সাহায্য করে।
৩. ন্যাপথলিন কেন বিপজ্জনক?
ন্যাপথলিন একটি সম্ভাব্য কার্সিনোজেন (ক্যান্সার সৃষ্টিকারী) পদার্থ। এর সংস্পর্শে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, অ্যানিমিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এটি পরিবেশ দূষণেও অবদান রাখে।
৪. কাপড় রক্ষায় কোনটি নিরাপদ: কর্পূর নাকি ন্যাপথলিন?
কর্পূর কাপড় রক্ষায় নিরাপদ বিকল্প। এটি প্রাকৃতিক, কম বিষাক্ত এবং পোকামাকড় তাড়াতে কার্যকর। ন্যাপথলিন বিষাক্ত বলে এর ব্যবহার এড়ানো উচিত।
৫. কর্পূর কি পূজার জন্য ন্যাপথলিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়?
না, পূজার জন্য শুধু কর্পূর ব্যবহার করা উচিত। ন্যাপথলিনের কোনো ধর্মীয় বা সুগন্ধি মূল্য নেই এবং এর বাষ্প স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৬. কীভাবে কর্পূর ও ন্যাপথলিন চেনা যায়?
- গন্ধ: কর্পূরের গন্ধ শীতল ও সতেজ, ন্যাপথলিনের গন্ধ উগ্র ও মথবলের মতো।
- পানিতে দ্রাব্যতা: কর্পূর পানিতে ভাসে, ন্যাপথলিন ডুবে যায়।
- প্যাকেজিং: কর্পূর পূজার দোকানে বা ফার্মেসিতে পাওয়া যায়, ন্যাপথলিন মথবল হিসেবে বাজারে বিক্রি হয়।
৭. কর্পূরের কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?
অতিরিক্ত কর্পূর গ্রহণ বা ত্বকে বেশি ব্যবহারে জ্বালাপোড়া হতে পারে। শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ব্যবহার করুন।
৮. বাংলাদেশে কর্পূর ও ন্যাপথলিন কোথায় পাওয়া যায়?
কর্পূর পূজার দোকান, ফার্মেসি বা সুপারমার্কেটে পাওয়া যায়। ন্যাপথলিন সাধারণত বাজারে মথবল হিসেবে বিক্রি হয়। কেনার সময় প্যাকেজিং পরীক্ষা করুন।
উপসংহার
কর্পূর ও ন্যাপথলিন দেখতে একই রকম হলেও এদের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কর্পূর প্রাকৃতিক, ঔষধি গুণসম্পন্ন এবং নিরাপদ, যেখানে ন্যাপথলিন শিল্পজাত ও বিষাক্ত। কাপড় রক্ষা, পূজা বা ঔষধি প্রয়োজনে কর্পূর বেছে নিন এবং ন্যাপথলিনের ব্যবহার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতার মাধ্যমে আপনি ও আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে পারেন।