জীবনে বরকত আনার ৮টি আমল | ইসলামে বরকত লাভের উপায়

Avatar

Published on:

জীবনে বরকত আনার ৮টি আমল | ইসলামে বরকত লাভের উপায়
জীবনে বরকত আনার ১০টি আমল

জীবনে বরকত মানে শুধু ধন-সম্পদ বা দীর্ঘ হায়াত নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া কল্যাণ যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—রিজিক, সময়, সন্তান-সন্ততি, এবং আমল-ইবাদতে—শান্তি ও সফলতা নিয়ে আসে। অনেকে প্রচুর পরিশ্রম করেন, কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত ফল পান না। আবার কেউ অল্প পুঁজিতে ব্যবসা বা সাধারণ চাকরিতে অসাধারণ কল্যাণ পান। এর পেছনে রয়েছে আল্লাহর দেওয়া বরকত। কিন্তু কীভাবে এই বরকত লাভ করবেন? কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এমন ৮টি আমল রয়েছে, যা আপনার জীবনে বরকত নিয়ে আসতে পারে। চলুন, জেনে নিই এই আমলগুলো এবং কীভাবে সেগুলো জীবনে প্রয়োগ করবেন।

১. বেশি বেশি ইস্তিগফার করা

ইস্তিগফার (আস্তাগফিরুল্লাহ) জীবনে বরকত লাভের অন্যতম আমল। এটি কোনো নির্দিষ্ট সময় বা সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি মুহূর্তে, যেকোনো পরিস্থিতিতে ইস্তিগফার করা যায়। এটি বলার সময় মনে মনে অনুভব করুন যে আপনি আল্লাহর কাছে সব পাপ ও ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছেন। এই মানসিকতা আল্লাহর রহমত ও বরকত নিয়ে আসে।

কুরআনের প্রমাণ:
আল্লাহ তাআলা সূরা নূহে বলেন,
"তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং নদীনালা প্রবাহিত করবেন।" (সূরা নূহ: ১০-১২)

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি ইস্তিগফার ধরে রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য প্রতিটি কঠিন অবস্থায় বের হওয়ার পথ করে দেবেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে রিজিক দেবেন।" (ইবনে মাজাহ)

কীভাবে করবেন?:

  • দিনে কমপক্ষে ১০০ বার "আস্তাগফিরুল্লাহ" বলুন।
  • নামাজের পর, ঘুমানোর আগে, বা যেকোনো ফাঁকা সময়ে ইস্তিগফার করুন।
  • পূর্ণ দোয়া: "আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযী লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম ওয়া আতুবু ইলাইহি।"

২. আল্লাহর ওপর ভরসা করা

আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা (তাওয়াক্কুল) বরকত লাভের একটি বড় আমল। যত বেশি আল্লাহর উপর নির্ভর করবেন, তত বেশি তিনি আপনাকে সাহায্য করবেন। বিপদে ধৈর্য ধরে আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা বরকতের পথ খুলে দেয়।

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করো, তাহলে তিনি তোমাদেরকে পাখির মতো রিজিক দেবেন, যারা সকালে খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় পূর্ণ পেটে ফিরে।" (তিরমিযী)

কীভাবে করবেন?:

  • প্রতিটি কাজের শুরুতে আল্লাহর উপর ভরসা করে দোয়া করুন: "হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল।"
  • বিপদে ধৈর্য ধরুন এবং আল্লাহর রহমতের উপর আস্থা রাখুন।
  • কাজের পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য চান, শুধু নিজের চেষ্টার উপর ভরসা করবেন না।

৩. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া

নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং পরিবারের সদস্যদের নামাজের প্রতি উৎসাহিত করা জীবনে বরকত আনে। নামাজ শুধু ইবাদত নয়, বরং এটি জীবনের শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর সাথে সংযোগ বাড়ায়।

কুরআনের প্রমাণ:
আল্লাহ তাআলা বলেন, "আপনার পরিবারের লোকদের নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোনো রিজিক চাই না। আমি আপনাকে রিজিক দেই।" (সূরা ত্বাহা: ১৩২)

কীভাবে করবেন?:

  • প্রতি ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করুন।
  • পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে সন্তানদের, নামাজের গুরুত্ব বোঝান।
  • জামাতে নামাজ পড়ার চেষ্টা করুন, কারণ এতে বরকত বেশি।

৪. সকালবেলা কাজ শুরু করা

সকালের সময় আল্লাহর দেওয়া বরকতময় সময়। দিনের শুরুতে কাজ শুরু করলে, তা ব্যবসা, চাকরি বা ঘরের কাজ হোক, তাতে কল্যাণ আসে।

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "হে আল্লাহ! আমার উম্মতের জন্য সকালের সময়ে বরকত দিন।" (আবু দাউদ)

কীভাবে করবেন?:

  • ফজরের নামাজের পর দিনের কাজের পরিকল্পনা করুন।
  • সকালে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করবেন না।
  • ব্যবসা বা অফিসের কাজ সকালে শুরু করুন, এমনকি ঘরের ছোট কাজও।

৫. দান-সদকা করা

দান-সদকা জীবনে বরকত আনার একটি পরীক্ষিত আমল। এটি বিপদ-মুসিবত দূর করে এবং রিজিকে কল্যাণ যোগায়। পরিমাণে কম হলেও নিয়মিত দান করা গুরুত্বপূর্ণ।

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "একটি খেজুরের টুকরো দিয়েও হোক, দান করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।" (বুখারী)

কীভাবে করবেন?:

  • সাধ্যানুযায়ী নিয়মিত সদকা দিন, এমনকি অল্প পরিমাণেও।
  • ঘরে একটি সদকার বাক্স রাখুন এবং প্রতিদিন কিছু জমা করুন।
  • গরিব-দুঃখী, মসজিদ, বা দাতব্য সংস্থায় দান করুন।

৬. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা

আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বরকতের একটি বড় কারণ। এমনকি তারা খারাপ ব্যবহার করলেও তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা উচিত।

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি তার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহ তার রিজিক বাড়ান এবং তার আয়ুতে বরকত দান করেন।" (বুখারী)

কীভাবে করবেন?:

  • মা-বাবা, ভাই-বোন, এবং অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করুন।
  • তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করুন বা সুন্দর ব্যবহার করুন।
  • ঝগড়া বা মনোমালিন্য এড়িয়ে ক্ষমাশীল হোন।

৭. প্রতিটি কাজে বিসমিল্লাহ বলা

প্রতিটি কাজের শুরুতে "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" বলা শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করে এবং কাজে বরকত নিয়ে আসে।

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যখন কেউ খাবার খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলে, শয়তান তার সাথে অংশ নিতে পারে না।" (মুসলিম)

কীভাবে করবেন?:

  • খাওয়া, ঘরে প্রবেশ, কাজ শুরু, বা যেকোনো কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলুন।
  • গাড়িতে উঠে বা বাইরে যাওয়ার সময়ও এটি বলুন।
  • এটি অভ্যাসে পরিণত করুন।

৮. কুরআনের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো

কুরআন তিলাওয়াত, অধ্যয়ন এবং এর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গড়া বরকতের অন্যতম উৎস। যে ঘরে কুরআনের চর্চা হয়, সেখানে আল্লাহর রহমত ও বরকত নেমে আসে।

কুরআনের প্রমাণ:
আল্লাহ তাআলা বলেন, "এটি একটি মঙ্গলময় কিতাব, যা আমি অবতীর্ণ করেছি। অতএব, এর অনুসরণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।" (সূরা আনআম: ১৫৫)

হাদিসের প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "কুরআন দিয়ে আল্লাহ অনেককে উঁচু করবেন এবং যারা এর থেকে দূরে থাকবে, তাদের নিচু করবেন।" (মুসলিম)

কীভাবে করবেন?:

  • প্রতিদিন কুরআনের একটি অংশ তিলাওয়াত করুন।
  • কুরআনের তাফসীর পড়ে এর শিক্ষা বুঝুন।
  • জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশনা মেনে চলুন।

কেন বরকত গুরুত্বপূর্ণ?

বরকত শুধু ধন-সম্পদ বাড়ায় না, বরং সময়, স্বাস্থ্য, পরিবার এবং ইবাদতেও কল্যাণ নিয়ে আসে। এটি আল্লাহর একটি বিশেষ নেয়ামত, যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। বরকত ছাড়া জীবন অপূর্ণ থেকে যায়, এমনকি প্রচুর সম্পদ থাকলেও। উপরের আমলগুলো নিয়মিত করলে আপনার জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং আল্লাহর রহমত নেমে আসবে।

অতিরিক্ত টিপস

  • দোয়া করুন: রিজিকের বরকতের জন্য এই দোয়া পড়ুন: "আল্লাহুম্মা ইকফিনী বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়া আগনিনী বিফাজলিকা আম্মান সিওয়াক।"
  • হালাল রিজিক: সবসময় হালাল উপার্জনের চেষ্টা করুন, কারণ হারাম রিজিকে বরকত থাকে না।
  • ধৈর্য ধরুন: বরকত আসতে সময় লাগতে পারে, তাই ধৈর্যের সাথে আমল চালিয়ে যান।

উপসংহার

জীবনে বরকত আল্লাহর একটি বিশেষ নেয়ামত, যা ইস্তিগফার, তাওয়াক্কুল, নামাজ, দান, এবং কুরআনের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এই ৮টি আমল নিয়মিত করলে আপনার জীবনে রিজিক, সময় এবং ইবাদতে কল্যাণ নেমে আসবে। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে এই আমলগুলো শুরু করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা কমেন্টে শেয়ার করুন! আরও ইসলামিক টিপসের জন্য আমাদের সাথে থাকুন।

Clap Button
0%
Smile Button
0%
Sad Button
0%

Related Posts

সঙ্গে থাকুন ➥