নাসার ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা: বিস্তারিত জানুন

Avatar

Published on:

নাসার ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা: বিস্তারিত জানুন

নাসা ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের চাঁদে স্থায়ী মানব ঘাঁটি তৈরির লক্ষ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পারমাণবিক চুল্লি চন্দ্রপৃষ্ঠে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে, যা স্থায়ী বসতির জন্য অপরিহার্য। তবে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বাজেট হ্রাস এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মতো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা নাসার এই পরিকল্পনা, এর গুরুত্ব, এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

নাসার চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা

নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান এবং মার্কিন পরিবহনমন্ত্রী শন ডাফি ঘোষণা করেছেন যে, নাসা ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে ১০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন করতে চায়। এই চুল্লি চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। পলিটিকোর এক প্রতিবেদন অনুসারে, শন ডাফি চীন ও রাশিয়ার অনুরূপ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই দুই দেশ চাঁদে নিজ নিজ অঞ্চল বা "কিপ-আউট জোন" ঘোষণা করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্র মিশনের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

এই পরিকল্পনা নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ, যার লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানো এবং ২০৩০ সালের মধ্যে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন। পারমাণবিক চুল্লি এই ঘাঁটির জন্য নিরবচ্ছিন্ন শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করবে, বিশেষ করে চাঁদের দুই সপ্তাহব্যাপী রাতের সময়, যখন সৌরশক্তি ব্যবহার অকার্যকর।

কেন পারমাণবিক চুল্লি?

চাঁদের পৃষ্ঠে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পারমাণবিক চুল্লি একটি আদর্শ সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সৌরশক্তির উপর নির্ভর করা চ্যালেঞ্জিং কারণ চাঁদে একটি দিন পৃথিবীর চার সপ্তাহের সমান, যার মধ্যে দুই সপ্তাহ অবিচ্ছিন্ন সূর্যালোক এবং দুই সপ্তাহ অন্ধকার থাকে। সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষক ড. সুংউ লিম বলেন, "একটি ছোট চন্দ্র ঘাঁটির জন্যও মেগাওয়াট-স্কেল বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রয়োজন, যা সৌর প্যানেল ও ব্যাটারি দিয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়।" তিনি আরও বলেন, "পারমাণবিক শক্তি কেবল পছন্দসই নয়, এটি অপরিহার্য।"

ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবী ও গ্রহ বিজ্ঞানের অধ্যাপক লিওনেল উইলসন মনে করেন, পর্যাপ্ত অর্থায়ন থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন সম্ভব। তিনি জানান, ইতিমধ্যে ছোট আকারের চুল্লির ডিজাইন প্রস্তুত রয়েছে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

নাসার এই পরিকল্পনার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। চীন ও রাশিয়া ২০৩৫ সালের মধ্যে চাঁদে একটি স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে উৎসাহিত করেছে। নাসার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পলিটিকোকে বলেন, "এটি দ্বিতীয় মহাকাশ দৌড়ে জয়ী হওয়ার বিষয়।"

শন ডাফি উল্লেখ করেছেন যে, চীন ও রাশিয়া চাঁদে তাদের ঘাঁটির চারপাশে "নিরাপত্তা অঞ্চল" ঘোষণা করতে পারে, যা আর্টেমিস অ্যাকর্ডের অধীনে সম্ভব। এই অ্যাকর্ড ২০২০ সালে সাতটি দেশ স্বাক্ষর করেছিল, যা চাঁদে সহযোগিতার নীতি নির্ধারণ করে। তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই নিরাপত্তা অঞ্চলগুলো কার্যত চাঁদের নির্দিষ্ট অংশের উপর দাবি হিসেবে কাজ করতে পারে।

চ্যালেঞ্জ ও বাজেট সংকট

নাসার এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, নাসার বাজেট সম্প্রতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ২০২৬ সালের জন্য মানব মহাকাশ অভিযানের বাজেট বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও, বিজ্ঞান মিশনের জন্য প্রায় ৫০% বাজেট কাটার পরিকল্পনা করেছে। এটি পারমাণবিক চুল্লি প্রকল্পের জন্য অর্থায়নের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

দ্বিতীয়ত, চাঁদের কঠিন পরিবেশে একটি পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন করা প্রযুক্তিগতভাবে জটিল। চুল্লিটি অবশ্যই কমপ্যাক্ট, হালকা, এবং মহাকাশে উৎক্ষেপণ ও চাঁদের পরিবেশে টিকে থাকার উপযোগী হতে হবে। নাসা ইতিমধ্যে ৪০ কিলোওয়াট ক্ষমতার চুল্লির গবেষণা করেছে, তবে ১০০ কিলোওয়াট ক্ষমতার চুল্লি তৈরি একটি বড় ধাপ।

শিল্পখাতের সাথে অংশীদারিত্ব

নাসা এই প্রকল্পে শিল্পখাতের সাথে অংশীদারিত্বের উপর জোর দিচ্ছে। শন ডাফি নির্দেশ দিয়েছেন যে, ৬০ দিনের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হবে। লকহিড মার্টিন, ওয়েস্টিংহাউস, এবং ইনটুইটিভ মেশিনসের সাথে এক্স-এনার্জির মতো কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে ৪০ কিলোওয়াট চুল্লির ডিজাইন নিয়ে কাজ করছে। এই অংশীদারিত্ব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং খরচ কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চীন ও রাশিয়ার পরিকল্পনা

চীন ও রাশিয়া ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের যৌথ প্রকল্প, ইন্টারন্যাশনাল লুনার রিসার্চ স্টেশন (আইএলআরএস)-এর জন্য একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। চীনের চ্যাং’ই-৮ মিশন, যা ২০২৮ সালে উৎক্ষেপণের জন্য নির্ধারিত, এই ঘাঁটির ভিত্তি স্থাপন করবে। রাশিয়ার রসকসমস প্রধান ইউরি বোরিসভ জানিয়েছেন, এই চুল্লি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে এবং মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই কাজ করবে।

চীন ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে তাদের প্রথম নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, যা নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করছে। এই প্রতিযোগিতা মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৌড়ের সূচনা করেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

নাসার পারমাণবিক চুল্লি প্রকল্প শুধু চাঁদে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যই নয়, এটি ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মিশন এবং মহাকাশে জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। শন ডাফি বলেন, "এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের চন্দ্র অর্থনীতি এবং মঙ্গল গ্রহে উচ্চ শক্তি উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য।"

এই প্রকল্প সফল হলে, এটি মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করবে। তবে, প্রযুক্তিগত জটিলতা, বাজেট সীমাবদ্ধতা, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

উপসংহার

নাসার ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা মহাকাশ গবেষণায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার একটি কৌশল। যদিও বাজেট হ্রাস এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এই পরিকল্পনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তবুও এটি মানবতার মহাকাশ অনুসন্ধানের ভবিষ্যৎ গঠনে একটি মাইলফলক হতে পারে।

সূত্র:

  • পলিটিকো

  • নিউইয়র্ক টাইমস

  • ফার্স্টপোস্ট

Clap Button
0%
Smile Button
0%
Sad Button
0%

Related Posts

সঙ্গে থাকুন ➥