মালদ্বীপ, তার স্ফটিক স্বচ্ছ জল, সাদা বালির সমুদ্র সৈকত এবং বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্য বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের কাছে একটি স্বপ্নের গন্তব্য। বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় কারণ মালদ্বীপ একটি ভিসা-মুক্ত গন্তব্য এবং ঢাকা থেকে তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি। এই গাইডে আমরা ২০২৫ সালের জন্য মালদ্বীপ টুরিস্ট ভিসার প্রয়োজনীয় তথ্য, প্রবেশের শর্তাবলী, খরচ এবং ভ্রমণের টিপস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তথ্যগুলো মালদ্বীপ ইমিগ্রেশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৫ এর ভিত্তিতে সংগ্রহ করা হয়েছে।
মালদ্বীপে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা নীতি
মালদ্বীপ সকল জাতীয়তার পর্যটকদের জন্য আগমনের সময় ৩০ দিনের বিনামূল্যে টুরিস্ট ভিসা প্রদান করে। বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্যও এই সুবিধা প্রযোজ্য, এবং কোনো পূর্ব-অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। তবে, প্রবেশের জন্য কিছু মৌলিক শর্ত পূরণ করতে হবে, যা মালদ্বীপ ইমিগ্রেশন আইন ২০০৭ এর ধারা ৭ ও ৮ অনুযায়ী নির্ধারিত। ২০২৫ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ইসরায়েলি পাসপোর্টধারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, তবে এটি বাংলাদেশীদের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
মূল বৈশিষ্ট্য:
ভিসা টাইপ: Visa on Arrival (আগমনের সময় ভিসা)
মেয়াদ: ৩০ দিন (এক্সটেনশনসহ সর্বোচ্চ ৯০ দিন)
খরচ: বিনামূল্যে
আবেদন প্রক্রিয়া: মালে ভেলানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাৎক্ষণিকভাবে ইস্যু করা হয়
মালদ্বীপ টুরিস্ট ভিসার প্রয়োজনীয় শর্তাবলী
মালদ্বীপে টুরিস্ট ভিসা পেতে নিম্নলিখিত শর্তাবলী পূরণ করতে হবে:
পাসপোর্ট:
মেশিন রিডেবল জোন (MRZ) সহ বৈধ পাসপোর্ট।
প্রবেশের তারিখ থেকে কমপক্ষে ১ মাসের বৈধতা থাকতে হবে।
মেয়াদ বাড়ানো পাসপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়।
ট্রাভেল ইটিনারারি:
নিশ্চিত রিটার্ন টিকিট।
নিবন্ধিত হোটেল, রিসোর্ট, বা গেস্টহাউসে প্রি-পেইড বুকিং কনফার্মেশন।
বিকল্পভাবে, আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ (প্রতিদিন প্রায় ১০০-১৫০ মার্কিন ডলার) বা প্রি-অ্যাপ্রুভড স্পনসরশিপ ভিসা।
ট্রাভেলার ডিক্লারেশন ফর্ম:
ফ্লাইটের ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে IMUGA পোর্টাল (https://imuga.immigration.gov.mv/) এর মাধ্যমে ফর্ম পূরণ ও জমা দিতে হবে।
এটি বিনামূল্যে এবং আগমন ও প্রস্থান উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ইয়েলো ফিভার টিকা:
ইয়েলো ফিভার ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে ভ্রমণকারীদের জন্য টিকার সার্টিফিকেট প্রয়োজন।
১ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
অন্যান্য গন্তব্যের প্রয়োজনীয়তা:
পরবর্তী গন্তব্যের জন্য ভিসা এবং পাসপোর্টের বৈধতা থাকতে হবে (যদি প্রযোজ্য হয়)।
গুরুত্বপূর্ণ নোট:
সম্পূর্ণ ডকুমেন্ট থাকলেও প্রবেশের নিশ্চয়তা নেই। ইমিগ্রেশন অফিসারদের বিবেচনার ভিত্তিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
মালদ্বীপ টুরিস্ট ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া
মালদ্বীপের টুরিস্ট ভিসা পাওয়া সহজ এবং পূর্ব-আবেদনের প্রয়োজন নেই। নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
ডকুমেন্ট প্রস্তুত করুন:
পাসপোর্ট, রিটার্ন টিকিট, হোটেল বুকিং, এবং আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ সংগ্রহ করুন।
ডকুমেন্টগুলো ইংরেজিতে হতে হবে বা নোটারাইজড অনুবাদ থাকতে হবে।
ট্রাভেলার ডিক্লারেশন পূরণ:
ফ্লাইটের ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে IMUGA পোর্টালে ফর্ম পূরণ করুন।
ইমিগ্রেশন কাউন্টার:
মালে ভেলানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ডকুমেন্ট জমা দিন।
ভিসা প্রাপ্তি:
শর্ত পূরণ হলে ইমিগ্রেশন অফিসার ৩০ দিনের টুরিস্ট ভিসা ইস্যু করবেন, যা বিনামূল্যে।
ভিসা এক্সটেনশন
টুরিস্ট ভিসা ৩০ দিনের জন্য ইস্যু করা হয়, তবে এটি অতিরিক্ত ৬০ দিন (মোট ৯০ দিন) পর্যন্ত এক্সটেন্ড করা যায়। এক্সটেনশন প্রক্রিয়া:
আবেদন: মালে ইমিগ্রেশন হেড অফিসে ভিসা এক্সটেনশন ফর্ম (IM23) জমা দিন।
ফি: প্রায় ৭৫০ মালদ্বীপীয় রুফিয়া (প্রায় ৫,৮০০ টাকা)।
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট: পাসপোর্ট, আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ, এবং থাকার ব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ।
গুরুত্বপূর্ণ: ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আবেদন করতে হবে। অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য ১৫,০০০ রুফিয়া জরিমানা বা ডিপোর্টেশনের ঝুঁকি রয়েছে।
মালদ্বীপ ভ্রমণের খরচ (২০২৫)
বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য মালদ্বীপ ভ্রমণের আনুমানিক খরচ নিম্নরূপ:
খাত | খরচ (টাকা) | বিস্তারিত |
---|---|---|
ভিসা ফি | ০ (বিনামূল্যে) | আগমনের সময় টুরিস্ট ভিসা |
ভিসা এক্সটেনশন ফি | ৫,৮০০ | প্রতি মাস (যদি প্রয়োজন হয়) |
ফ্লাইট খরচ (রাউন্ড-ট্রিপ) | ৩৫,০০০ - ৫০,০০০ | ঢাকা-মালে (বিমান বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স) |
থাকার খরচ | ৩,০০০ - ৫০,০০০/দিন | গেস্টহাউস (৩,০০০-৫,০০০), রিসোর্ট (১০,০০০-৫০,০০০) |
দৈনিক খরচ (খাবার, পরিবহন) | ৫,০০০ - ১০,০০০/দিন | স্পিডবোট, সীপ্লেন, খাবার, ট্যুর |
মোট (৭ দিনের ট্রিপ) | ৬০,০০০ - ১,০০,০০০ | গেস্টহাউস ভিত্তিক, রিসোর্টে বেশি হতে পারে |
ভ্রমণের টিপস
পাসপোর্টের বৈধতা:
নিশ্চিত করুন পাসপোর্টে কমপক্ষে ১ মাসের বৈধতা এবং ২টি ফাঁকা পৃষ্ঠা রয়েছে।
ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স:
মেডিকেল এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত খরচ কভার করে এমন ইন্স্যুরেন্স কিনুন।
নিষিদ্ধ জিনিসপত্র:
মালদ্বীপে অ্যালকোহল, শুয়োরের মাংস, এবং ধর্মীয় উপকরণ (যেমন, বাইবেল) আনা নিষিদ্ধ।
স্থানীয় রীতিনীতি:
মালে এবং স্থানীয় দ্বীপে ইসলামিক পোশাকের নিয়ম মেনে চলুন। রিসোর্ট দ্বীপে এই নিয়ম শিথিল।
ইয়েলো ফিভার ঝুঁকি:
ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে ভ্রমণকারীরা টিকার সার্টিফিকেট সঙ্গে রাখুন।
এজেন্ট এড়িয়ে চলুন:
অফিসিয়াল IMUGA পোর্টাল বা মালদ্বীপ ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইট (immigration.gov.mv) ব্যবহার করুন। ফেক এজেন্ট থেকে সাবধান।
ইসরায়েলে ভ্রমণের ইতিহাস:
বাংলাদেশী পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণ নিষিদ্ধ। মালদ্বীপেও ইসরায়েলি পাসপোর্টধারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ (১৫ এপ্রিল ২০২৫ থেকে)।
FAQ
১. বাংলাদেশী পাসপোর্টে মালদ্বীপে ভিসা লাগবে?
না, বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য মালদ্বীপে টুরিস্ট ভিসা আগমনের সময় বিনামূল্যে দেওয়া হয়, যদি মৌলিক শর্ত পূরণ হয়।
২. মালদ্বীপ ভিসা কত দিনের জন্য বৈধ?
টুরিস্ট ভিসা ৩০ দিনের জন্য বৈধ, যা ৬০ দিন পর্যন্ত এক্সটেন্ড করা যায়। মোট থাকার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৯০ দিন।
৩. ভিসার স্ট্যাটাস কীভাবে চেক করব?
IMUGA পোর্টালে পাসপোর্ট নাম্বার এবং অ্যাপ্লিকেশন রেফারেন্স নাম্বার দিয়ে স্ট্যাটাস চেক করা যায়।
৪. মালদ্বীপে কাজ করতে পারব?
টুরিস্ট ভিসায় কোনো প্রকার কাজ (প্রদত্ত বা অপ্রদত্ত) নিষিদ্ধ। কাজের জন্য ওয়ার্ক ভিসা প্রয়োজন, যা নিয়োগকর্তার মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।
৫. কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়ম কী?
২০২৫ সালে কোনো কোভিড টেস্ট বা ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। তবে, মাস্ক ও স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখুন।
উপসংহার
মালদ্বীপ বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য একটি সহজ এবং আকর্ষণীয় গন্তব্য। ভিসা-মুক্ত প্রবেশ, সহজ আবেদন প্রক্রিয়া, এবং অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এটিকে একটি আদর্শ ছুটির গন্তব্য করে তুলেছে। সঠিক ডকুমেন্ট এবং প্রস্তুতি নিশ্চিত করলে আপনি মালদ্বীপের স্ফটিক জল আর বিলাসবহুল রিসোর্টে একটি স্মরণীয় ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে নিচে কমেন্ট করুন এবং এই গাইড শেয়ার করে অন্যদের সাহায্য করুন!
অফিসিয়াল তথ্যের জন্য মালদ্বীপ ইমিগ্রেশনের ওয়েবসাইট (immigration.gov.mv) ভিজিট করুন।