টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০২৫ – এই নীতিমালা বাংলাদেশের টেলিকমিউনিকেশন খাতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছে। ২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এই নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে, যা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রণীত। এটি পুরনো জটিল লাইসেন্সিং কাঠামোকে সরলীকরণ করে, ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে এবং ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবার মান উন্নয়ন করবে। কিন্তু কেন এই নীতিমালা এত গুরুত্বপূর্ণ? এটি কীভাবে অর্থনীতি, গ্রাহক এবং বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে? এই বিস্তারিত নিবন্ধে আমরা নীতিমালার পটভূমি, মূল বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব, চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ প্রভাব এবং বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করব।
টেলিকম খাতের পটভূমি: কেন নতুন নীতিমালা দরকার?
বাংলাদেশের টেলিকম খাত ১৯৯০-এর দশক থেকে দ্রুত বিকশিত হয়েছে। ২০২৫ সালে দেশে ১৮ কোটিরও বেশি মোবাইল সংযোগ এবং ১.৫ কোটি ব্রডব্যান্ড ইউজার রয়েছে। কিন্তু পুরনো লাইসেন্সিং নীতিমালা (২০১০-এর দশকের) জটিলতা, অসংখ্য লাইসেন্স (২৬ ধরনের ৩,২৯৯টি) এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে সেবার মান কমেছে। বিটিআরসি রিপোর্ট অনুসারে, এতে ইন্টারনেটের গড় গতি ২০ এমবিপিএস-এ সীমাবদ্ধ এবং ডাউনটাইম ১৫% বেশি।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অন্তর্বর্তী সরকার টেলিকম খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এপ্রিল ২০২৫-এ খসড়া প্রকাশিত হয় এবং জুলাই মাসে পর্যালোচনা কমিটি (চেয়ারম্যান: ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ) গঠিত হয়। সেপ্টেম্বরে অনুমোদিত নীতিমালা ২০১০-এর আইএলডিটিএস নীতিমালা সংস্কার করে ডিজিটাল ইকোনমির ভিত্তি মজবুত করবে। রিসিং বিডি অনুসারে, এটি ৫জি এবং ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের প্রসারে সহায়ক।
বাংলাদেশের জিডিপি-তে টেলিকম খাতের অবদান ৩% এবং এটি ৫ লক্ষ কর্মসংস্থান প্রদান করে। নতুন নীতিমালা ছাড়া ২০৩০ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।
নীতিমালার মূল বৈশিষ্ট্য: কী পরিবর্তন এনেছে?
নীতিমালা ২০২৫ পুরনো ২৬ ধরনের লাইসেন্সকে ৩টি মূল ক্যাটাগরিতে সংক্ষিপ্ত করেছে:
- অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার (এনএনএসপি): মোবাইল এবং ফিক্সড ফোন অপারেটরদের জন্য। এতে গ্রাহক-সরাসরি সেবা অন্তর্ভুক্ত।
- ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কমন সার্ভিস প্রোভাইডার (এনআইসিএসপি): ন্যাশনাল টেলিকম ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) এবং আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। বিদেশি মালিকানা ৭০% পর্যন্ত।
- কনটেন্ট অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএএসপি): ওভিপিও, ভিওডি এবং ডিজিটাল সার্ভিসের জন্য।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য:
- বিদেশি বিনিয়োগ: মোবাইল অপারেটরে ৮০% বিদেশি মালিকানা, আইএসপি-তে ৭০%।
- রেভিনিউ শেয়ারিং: ৫.৫% রাজস্ব ভাগাভাগি এবং ১% সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসওএফ)।
- সেবার মান: মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) স্বতন্ত্র লাইসেন্স, ৫জি স্পেকট্রাম অ্যালোকেশন।
- মধ্যস্বত্বভোগী হ্রাস: আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স এবং নিক্সের আলাদা লাইসেন্স বাতিল।
ইত্তেফাক অনুসারে, এটি লাইসেন্সিং খরচ ৩০% কমাবে এবং সেবার দাম স্থিতিশীল রাখবে। তবে, আইএসপিএবি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) শঙ্কা প্রকাশ করেছে যে উচ্চ লাইসেন্স ফি ইন্টারনেটের দাম ২০% বাড়াতে পারে।
নীতিমালার গুরুত্ব: অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব
১. ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন
নীতিমালা ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক এবং ৫জি-এর প্রসার ঘটাবে। বিটিআরসি অনুসারে, এনটিটিএন অপারেটররা ৫০,০০০ কিলোমিটার অপটিক ফাইবার বিস্তার করবে, যা গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট কভারেজ ৯০% বাড়াবে। এটি ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন ২০৪১-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২. বিনিয়োগ আকর্ষণ
বিদেশি মালিকানা বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণের সম্ভাবনা। সমকাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটি চীনা এবং ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করবে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর জন্য এনটিটিএন লাইসেন্স সহজ হবে, যা কর্মসংস্থান বাড়াবে।
৩. গ্রাহকের সুবিধা
মধ্যস্বত্বভোগী কমে সেবার দাম কমবে এবং মান বাড়বে। মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি সক্রিয় হলে গ্রাহকরা সহজে অপারেটর পরিবর্তন করতে পারবে। প্রথম আলো অনুসারে, এটি ডাউনটাইম ২০% কমাবে এবং গতি ৫০ এমবিপিএস-এ নেবে।
৪. নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা
সাইবার সিকিউরিটি এবং ডেটা প্রাইভেসি নিয়ে নতুন নিয়মাবলী। এসওএফ ফান্ড গ্রামীণ ডিজিটালাইজেশনে ব্যয় হবে।
৫. অর্থনৈতিক প্রভাব
টেলিকম খাত জিডিপি-তে ৪% অবদান দেবে। খবরের কাগজ অনুসারে, ২০২৫-৩০ সালে ১০ লক্ষ নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা: কী বলছেন স্টেকহোল্ডাররা?
নীতিমালা সত্ত্বেও কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা: আইএসপিএবি বলছে, উচ্চ লাইসেন্স ফি এবং রেভিনিউ শেয়ারিং ইন্টারনেটের দাম ২০% বাড়াবে। ইত্তেফাক রিপোর্টে এটি উল্লেখ করা হয়েছে।
- দেশীয় কোম্পানির ঝুঁকি: বিদেশি মালিকানা বাড়ায় এনটিটিএন এবং আইএসপি-রা সংকটে পড়তে পারে। সমকাল অনুসারে, বিএনপি এবং অন্যান্য দল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
- বাস্তবায়নের জটিলতা: লাইসেন্স রূপান্তরে ৬ মাস লাগতে পারে, যা সেবা ব্যাহত করতে পারে।
- সাইবার নিরাপত্তা: নতুন নিয়মাবলী বাস্তবায়ন না হলে ঝুঁকি বাড়বে।
সময়ের লোক অনুসারে, ৩টি কোম্পানি প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে, সরকার পর্যালোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নীতিমালার ভবিষ্যৎ প্রভাব: ২০৩০ পর্যন্ত
২০৩০ সাল নাগাদ:
- ইন্টারনেট কভারেজ: ৯৫% জনগণের অ্যাক্সেস।
- ৫জি রোলআউট: ২০২৭ সালে শুরু, ১০০ মেগাসিটিতে।
- ডিজিটাল ইকোনমি: ই-কমার্স এবং ফিনটেক ২০% বৃদ্ধি।
- গ্রামীণ উন্নয়ন: এসওএফ ফান্ড ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ।
বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ডিজিটাল হাব করবে।
উপসংহার
টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০২৫ বাংলাদেশের টেলিকম খাতকে আধুনিকীকরণ করে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটাবে। লাইসেন্স সরলীকরণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং সেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে এটি অর্থনীতি এবং সমাজকে শক্তিশালী করবে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় এগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে ডিজিটাল সুপারপাওয়ার হিসেবে গড়ে তুলুন। সর্বদা বিশ্বস্ত সূত্র থেকে আপডেট নিন এবং স্টেকহোল্ডারদের সাথে যোগাযোগ রাখুন।
প্রশ্ন-উত্তর সেকশন
১. টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতিমালা, ২০২৫ কখন অনুমোদিত হয়েছে?
উত্তর: ২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের দ্বারা।
২. নীতিমালায় কয়টি মূল লাইসেন্স ক্যাটাগরি?
উত্তর: ৩টি – এনএনএসপি, এনআইসিএসপি এবং সিএএসপি।
৩. এটি ইন্টারনেটের দাম কীভাবে প্রভাবিত করবে?
উত্তর: আইএসপিএবি অনুসারে ২০% বাড়তে পারে, কিন্তু সরলীকরণে দীর্ঘমেয়াদে কমবে।
৪. বিদেশি মালিকানার সীমা কত?
উত্তর: মোবাইল অপারেটরে ৮০%, আইএসপি-তে ৭০%।
৫. নীতিমালার সবচেয়ে বড় সুবিধা কী?
উত্তর: লাইসেন্স সংখ্যা কমিয়ে সেবার মান এবং বিনিয়োগ বাড়ানো।

